
ভূমিকা:
১.০ কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থ ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রশংসনীয় ভ‚মিকা পালন করে পিকেএসএফ বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। ফাউন্ডেশনের আদলে বর্তমানে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে এবং আরো অনেক দেশ এরূপ প্রতিষ্ঠান তৈরিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে পিকেএসএফ নিজস্ব ভাবমূর্তি ও স্বকীয়তা বজায় রেখে উন্নয়ন কর্মকাÐ বাস্তবায়নে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর নতুন নতুন কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত সীমিত সময়ের প্রকল্প হিসেবে নয় বরং একটি স্বশাসিত এবং স্বতন্ত্রধারার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিকেএসএফ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
প্রেক্ষাপট:
২.০ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে দীর্ঘদিনের আলাপ আলোচনা, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতবিনিময়, স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ এবং দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পার হয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পিকেএসএফ প্রতিষ্ঠার এ ইতিবৃত্ত কর্মসৃজনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে যথোপযুক্ত উন্নয়ন প্রয়াস চিহ্নিতকরণের ও সেটি বাস্তব রূপ প্রদানের অন্বেষণ প্রক্রিয়ার ইতিহাস। একটি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সূচিত উক্ত অন্বেষণ প্রক্রিয়া অর্ধযুগব্যাপী চলমান ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে পিকেএসএফ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সফল পরিসমাপ্তি লাভ করে। উক্ত প্রক্রিয়াভুক্ত চলমান ঘটনা প্রবাহকে লিপিবদ্ধ আকারে ধরে রাখার ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছাড়াও ইতিবৃত্তটি দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্রঋণ ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক, দেশি ও বিদেশি পরিকল্পনাবিদ এবং অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের নিকট উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের একটি অনন্য কেস স্টাডি হিসেবে পরিগণিত হবে বলে প্রতীয়মান হয়।
৩.০ ১৯৮৪ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প (Poverty Alleviation and Rural Employment Project)- শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ঘটনা প্রবাহের সূত্রপাত হয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
এই পুস্তিকার ৪-৯৪ নং অনুচ্ছেদে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে যে-সকল ঘটনার ক্রমবিকাশ বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো ফাউন্ডেশনে রক্ষিত কাগজ-পত্র থেকে নেয়া হয়েছে। পুস্তিকায় অন্তর্ভুক্ত ঘটনা পরম্পরা বর্ণনায় ফাউন্ডেশন বা ফাউন্ডেশনের কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত মতামত জুড়ে দেয়া হয়নি। পুস্তিকাটি পিকেএসএফএর ৮ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. কাজী মেসবাহউদ্দিন আহমেদ প্রণয়ন করেছেন। তাঁকে সাহায্য করেন জনাব রোকনুজ্জামান, তৎকালীন সহকারী ব্যবস্থাপক।
১৯৯০ সালের মে মাসে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উত্থাপিত প্রাথমিক ধারণাপত্রের সাথে তুলনা করা হলে দেখা যাবে যে, ১৯৯০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ পৃথক কাঠামো ও আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। ফাউন্ডেশন গঠনের পটভ‚মি সম্পর্কে অবহিত হবার জন্যে ধারাবাহিকভাবে ১৯৮৪ সাল থেকে এতসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নসংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হলো:
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন সৃষ্টির ঘটনার ক্রমবিকাশ: ১৯৮৪ সাল
৪.০ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প শীর্ষক প্রস্তাবের অব্যবহিত পরেই প্রকল্পপ্রস্তাবটি বাস্তবায়নের নিমিত্তে বিশ্বব্যাংক Bangladesh: A Framework for
Additional Efforts to Address Rural Poverty and Employment নামেএকটি দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের ধারণাপত্র সরকারের বিবেচনার জন্যে পেশ করে। উক্ত ধারণাপত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এবং ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের কৌশল সমন্বয় করে Upazila Employment Resource Centre
(UERC) স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। অধিকন্তু সরকারি কাঠামোর বাইরে একটি বিদেশী বেসরকারি সংস্থাকে (UERC) কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্যে বিশ্বব্যাংক প্রস্তাব করে।
৫.০ সরকারের পক্ষ হতে প্রস্তাবিত টঊজঈ প্রকল্প প্রস্তাবের বিষয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস-এর মতামত চাওয়া হলে তিনি এর বিরোধিতা করে জুন ২৯, ১৯৮৪ সালে লিখিতভাবে তাঁর মতামত প্রদান করেন। তাঁর মতে, গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের পরীক্ষিত সফল দু’টি ভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রিত করে একটি নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করলেই সেটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে মূল কার্যক্রমগুলোর অনুরূপ সাফল্য বয়ে আনবে তার নিশ্চয়তা নেই। গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাক দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে। এর এক অংশ খুলে নিয়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করলে সেটা একইভাবে কার্যকরী হবে এটা ধারণা করাটা বোকামি হবে।’তদুপরি এরকম ক্ষেত্রে চলমান অপর দু’টি কর্মসূচির পরিকল্পিত স¤প্রসারণ ও কাক্সিক্ষত কার্যকারিতার ওপর নতুন আবিষ্কৃত প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি প্রকল্পের রূপরেখা, বিদেশি উপদেষ্টা নিয়োগ, বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব, প্রোগ্রাম কমিটিতে দাতা সংস্থার প্রতিনিধি রাখা ইত্যাদি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি মন্তব্য করেন ‘‘মৌলিক দিক থেকে এটি অত্যন্ত দুর্বল প্রকল্প। —–অন্যান্য প্রকল্পের মতোই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার জন্যে অন্যদের দায়ী করেই প্রকল্প রচয়িতারা আত্মপ্রসাদ লাভ করবেন।”
৬.০ UERC -এর ধারণাপত্র এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনার জন্যে জুলাই ৮, ১৯৮৪ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম. মাহবুবুজ্জামানের সভাপতিত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত আলোচিত হয়। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের কর্মকর্তা ঙস চ. ঘরলযধধিহ উক্ত বৈঠকে আলোচিত টঊজঈ-এর ধারণাপত্রটি প্রণয়ন করেছেন বলে জানানো হয়। বৈঠকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রকল্পের ধারণাপত্র সম্বন্ধে ওপরে বর্ণিত তাঁর নেতিবাচক মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন যে, টঊজঈ একটি কার্যকরী মডেল নয়। এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনও তাঁদের স্ব স্ব মতামতের ভিত্তিতে টঊজঈ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। ১৬৭৭.০ এ বৈঠকে টঊজঈ-এর ধারণাপত্রের ওপর আরও গভীরভাবে বিচার বিবেচনা করে একটি কাযর্কর মডেল জন্যে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. এ.এইচ.এম শাহদাতউলাø হকে আহবায়ক করে ৮-সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
৮.০ উল্লিখিত কমিটি জুলাই ২৭, ১৯৮৪ তারিখে টঊজঈ-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা
করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে জুলাই ৩১, ১৯৮৪ তারিখে পুনরায় টঊজঈ-এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জুলাই ২৭, ১৯৮৪ তারিখে অনুষ্ঠিত পূর্বোল্লিখিত কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়। কমিটির সভাপতি অন্যান্য মন্তব্যের মধ্যে উল্লেখ করেন যে, প্রস্তাবিত টঊজঈ কর্তৃক কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করতে হলে এটি ধঃড়সরংঃরপধষষু’ পরিচালিত হতে হবে। অগণিত গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যে সরকারকে তত্ত¡গত অবস্থান থেকে সরে এসে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
৯.০ সভায় উপস্থিত অন্যান্যের মধ্যে বিআরডিবি-এর মহাপরিচালক ইরশাদুল হক গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে সরকারকে অতিরিক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে উল্লেখ করে টঊজঈ প্রকল্পটি সম্ভাব্য কি কি কারণে ব্যর্থ হবে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন।