
রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ টান্সফরমেশন (আরএমটিপি)

সৈয়দ কাওসার হোসাইন
কৃষি কর্মকর্তা (সহকারী পরিচালক), ফোকাল পার্সন, আরএমটিপি ও ইসিসিসিপি ড্রট প্রকল্প, শতফুল বাংলাদেশ।
ভূমিকা
আন্তর্জাতিক কৃষিউন্নয়ন তহবিল (IFAD) এবং ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (DANIDA)-র অর্থায়নে এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর কারিগরি সহযোগিতায় Rural Microenterprise Transformation Project (RMTP)-এর আওতায় “নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ” শীর্ষক ভ্যালু-চেইন উপ-প্রকল্পটি শতফুল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করছে। এই উপ-প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত চলমান থাকবে। রাজশাহী জেলার চারটি উপজেলা—মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর এবং পবা—জুড়ে ৮,০০০ জন সদস্যের সমন্বয়ে এই প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে পরিচালিত হচ্ছে।
উপ-প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
- নাম: নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ
- বাস্তবায়নকারী সংস্থা: শতফুল বাংলাদেশ, জাহানাবাদ, মোহনপুর, রাজশাহী
- মেয়াদকাল: জানুয়ারি ২০২৩ থেকে জুন ২০২৫ (২ বছর ৬ মাস)
- কর্মএলাকা: রাজশাহী জেলার পবা, মোহনপুর, বাগমারা এবং দুর্গাপুর উপজেলা
- সদস্য: মোট ৮,০০০ জন (১০% অতি-দরিদ্র, ২৭% দরিদ্র, ৬৩% ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, এবং ১২% তরুণ উদ্যোক্তা যাদের বয়স ১৮-৩৫ বছর)
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
লক্ষ্য
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্য চাষী পরিবার এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পারিবারিক পুষ্টি উন্নয়ন।
উদ্দেশ্য
- নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি।
- প্রক্রিয়াজাত মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধি।
- স্থানীয় পর্যায়ে নিরাপদ মৎস্য চাষ উপকরণ ও আধুনিক চাষ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।
- স্থানীয় পর্যায়ে সেবা বাজার তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও টেকসই খাত সৃষ্টি।
- পরিবেশ, নিরাপদ ও পুষ্টিমান খাদ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কে বিবেচনায় রেখে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি।
- উদ্যোগে নারী ও যুবকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
মার্কেট অ্যাক্টর ও সেবা প্রদানকারী
এই উপ-প্রকল্পের আওতায় মৎস্য সেক্টরের উৎপাদনকারী, উপকরণ ও প্রযুক্তি সরবরাহকারী, সেবা প্রদানকারী, ট্রেডার/বাজারজাতকারী, প্রক্রিয়াজাতকারী এবং খুচরা/পাইকারি বিক্রেতাদের সমন্বয়ে কাজ করা হচ্ছে। এই সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে মৎস্য সেক্টরের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
বাস্তবায়নাধীন কার্যক্রম
উপ-প্রকল্পটি চারটি প্রধান কম্পোনেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে:
কম্পোনেন্ট-১: উদ্যোক্তা নির্বাচন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
- ৮,০০০ জন সদস্য নির্বাচন এবং অনানুষ্ঠানিক উৎপাদনকারী দল গঠন।
- মৎস্য চাষে নিষিদ্ধ ও অনুমোদিত উপকরণ সনাক্তকরণ এবং নিরাপদ প্রয়োগমাত্রা বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়ন।
- আধানিবিড় পদ্ধতিতে মাছ ও চিংড়ি চাষের জন্য প্রদর্শনী প্লট স্থাপন।
- ফার্ম মেকানাইজেশন এবং স্মার্ট অ্যাকুয়াকালচার সলিউশন (IoT, AI, মাটি ও পানি পরীক্ষার কিট) সম্প্রসারণ।
- দ্রুত বর্ধনশীল মাছের নার্সিং এবং উচ্চমূল্যমানের দেশীয় প্রজাতির মাছের হ্যাচারি স্থাপনে সহায়তা।
- প্রোবায়োটিক ব্যবহার এবং কালো সৈনিক পোকার মাধ্যমে বাণিজ্যিক মৎস্য খাবারের বিকল্প উৎপাদন।
- ঝিনুক চাষের মাধ্যমে মুক্তা উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ।
- মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি (যেমন: পোনা নার্সিং, ফিশিং গিয়ার তৈরি, ইকোট্যুরিজম)।
- পুষ্টিমান, হাইজিন, স্যানিটেশন এবং পরিবেশ-জলবায়ু বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।
কম্পোনেন্ট-২: পণ্য ও বাজার উন্নয়ন
- “Ready to Cook” মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে উদ্যোক্তাদের সহায়তা।
- মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্য (ফিশ বল, ফিশ কাটলেট, ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ স্টিক, ফিশ ফ্রাই, ফিশ বারবিকিউ) উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ।
- কালো সৈনিক পোকা, ট্রাশ ফিশ, সি-উইড এবং ফিশ বাই-প্রোডাক্ট ব্যবহার করে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মৎস্য খাদ্য উৎপাদন।
- স্থানীয় মাছের বাজার ও আড়তের মান উন্নয়ন, বিশেষ করে হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
- নিরাপদ মৎস্য বিক্রয়ের জন্য কালেকশন পয়েন্ট উন্নয়ন এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ।
- ট্রেসেবিলিটি ও সনদায়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে নিরাপদ মাছের পৃথক সরবরাহ ব্যবস্থা প্রবর্তন।
কম্পোনেন্ট-৩: জনবল উন্নয়ন ও সেবা খাতের উন্নয়ন
- নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন বিষয়ক ভিডিও মডিউল ও চাষী সহায়িকা প্রস্তুতকরণ।
- HACCP, ISO, Global GAP for Fisheries বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়।
- ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, নতুন পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্রান্ডিং বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়ন।
- পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, জেন্ডার এবং নারী-যুব অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
- মৎস্য ও মৎস্য পণ্য বিপণন ও পরিবহনে Good Handling Practice বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়ন।
- ইউনিয়ন পর্যায়ে “মৎস্য সেবা ও পরামর্শ” কেন্দ্র স্থাপন।
- মাটি ও পানি পরীক্ষার জন্য ক্যাম্পেইন এবং অডিট/সার্টিফিকেশন বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন।
কম্পোনেন্ট-৪: পলিসি ও প্রাকটিস
- ভ্যালু চেইন স্টিয়ারিং কমিটি/গভর্নেন্স কমিটি গঠন ও ত্রৈমাসিক সভা আয়োজন।
- স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয়।
উপসংহার
“নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ” উপ-প্রকল্পটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্য চাষী এবং উদ্যোক্তাদের জন্য একটি টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন মডেল হিসেবে কাজ করছে। আধুনিক প্রযুক্তি, নিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতি এবং বাজারজাতকরণ কৌশলের মাধ্যমে এই প্রকল্প শুধু আয় বৃদ্ধিই নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নারী ও যুবকদের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় সেবা বাজারের উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রকল্প রাজশাহী অঞ্চলের মৎস্য সেক্টরে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।